বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত বছরের ৪ আগস্ট যখন সারাদেশ উত্তাল। ওই সময় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা মডেল কলেজে চলছে ল্যাব সহকারী (রসায়ন) পদে নিয়োগ পরীক্ষা। ৮ আগস্ট একজনকে নিয়োগও দেওয়া হয়। সেই পরীক্ষায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (ডিজি) প্রতিনিধি হিসেবে যার সই রয়েছে, সেটি জাল। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সইও জাল।
একটি অভিযোগের সূত্র ধরে খোঁজ নিতে গেলে বেরিয়ে আসে এসব অনিয়মের তথ্য। এ ছাড়া ইনডেক্সের বিনিময়ে মাউশি কর্মকর্তার মেয়ে ও ভাতিজার নিয়োগের অভিযোগও রয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনা তথ্য পদ্ধতির হিসাব মতে, কলেজটিতে বর্তমানে শিক্ষক-কর্মচারী ১১২ জন। অথচ, গত বছর কলেজটি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ১৫ জন অংশ নেন। তিনজন পাস করেন।
কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৪ আগস্ট কলেজে ল্যাব সহকারী (রসায়ন) পদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন সুজিত কুমার, মো. হাফিজুল ইসলাম ও আয়েশা সিদ্দিকা। সর্বোচ্চ নম্বরে আয়েশা সিদ্দিকা নির্বাচিত হন। ফলাফলের কাগজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাছেন আলী, বিষয় বিশেষজ্ঞ লালমনিরহাট মজিদা খাতুন সরকারি মহিলা কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক বিমল চন্দ্র বর্মণ, মাউশির ডিজি প্রতিনিধি লালমনিরহাট মজিদা খাতুন সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষক নজরুল ইসলাম, কলেজের দাতা সদস্য তছলিম উদ্দিন ও কলেজ সভাপতি ইউনুছ আলীর সই রয়েছে। এর চার দিন পর কলেজটিতে আয়েশা সিদ্দিকার নিয়োগ চূড়ান্ত হয়।
এ বিষয়ে প্রভাষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের জুনে অবসর নিয়েছি। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের পর হাতীবান্ধায় যাইনি। ৪ আগস্ট তো যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমার সই জাল করেছে।’ দাতা সদস্য তছলিম উদ্দিন বলেন, ‘আমাকে ডেকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সই নিয়েছে। কোথায় নিয়েছে, বলতে পারব না।’
নিয়োগ পাওয়া আয়েশা সিদ্দিকা মাউশি রংপুর অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক আমির আলীর মেয়ে। আর কলেজের বিজ্ঞান ল্যাবে সহকারী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া শাহিন আলম পরিচালক আমির আলীর ভাতিজা। প্রথম ধাপে ১৩ জন এমপিওভুক্তির ইনডেক্স তালিকায় রয়েছেন আয়েশা ও শাহিন।
এ বিষয়ে সাবেক প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ইউনুছ আলী বলেন, ‘মাউশি পরিচালক প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তার মেয়ে ও ভাতিজাকে নিলে টাকা ছাড়া কলেজের ইনডেক্স করে দেবেন।’
জানতে চাইলে রংপুর অঞ্চলের মাউশি অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক আমির আলী বলেন, ‘আয়েশা ও শাহিন নিয়ম মেনে নিয়োগ পেয়েছে।’ ইনডেক্স তালিকা পাঠানোর বিষয়টি অধ্যক্ষের এখতিয়ার। ইনডেক্স তালিকায় তার মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকার নামের পাশে ইউনুছ আলীর মোবাইল নম্বর ব্যবহার ও ইনডেক্স আবেদনে ইউএনওর সই জাল করার বিষয়টি নজরে আনলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়গুলো জানি না। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে হাতীবান্ধা মডেল কলেজ সভাপতি এবং ইউএনও শামীম মিঞা বলেন, আমার সই স্ক্যান করে ১৩ জনের ইনডেক্স করেছে। এটা জালিয়াতি। ইউএনও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাছেন আলীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাছেন আলী হাতীবান্ধা উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির। জামায়াতের জেলা নায়েবে আমির হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কলেজ নিয়ে বিতর্কিত হওয়ায় হাছেন আলীকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’
যুক্তিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মনির উদ্দিন বলেন, সাবেক অধ্যক্ষ ইউনুস আলী একেক শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বাণিজ্য করেছেন। মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাছেন আলীর যোগসাজশে নতুন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে ইনডেক্স করিয়েছেন।
সহকারী লাইব্রেরিয়ান নজরুল ইসলাম জানান, আমার বাবাসহ ৯ জন জমিদাতা সদস্য। শুরু থেকে আমি চাকরি করছি। কিন্তু নতুন করে অর্থের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ইউনুস আমাকে বাদ দিয়ে অন্য একজনকে নিয়োগ করার পাঁয়তারা করছেন।
হাছেন আলী ইউএনওর সই জালিয়াতির কথা স্বীকার করেছেন। তবে তিনি দোষ দিলেন কলেজের অফিস সহকারী শফিকুল ইসলামের ওপর। তাঁর দাবি, শফিকুল এই অপকর্ম করেছেন।
এদিকে সই জালিয়াতির বিষয়টি প্রকাশের পর সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন শফিুকল। তিনি বলেন, হাছেন আলী আমার সই স্ক্যান করে আমাকে দেওয়া শোকজের মনগড়া জবাব দিয়েছেন। এ বিষয়টি ইউএনও জানেন।
২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন অধ্যক্ষ নুরুজ্জামানকে সরিয়ে সভাপতি নুরুল ইসলাম কলেজে রেজুলেশনের মাধ্যমে হোসেন মো. নওশাদকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেন। এ সময় প্রায় ১৫ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ হন। তখন ৮২ লাখ টাকার নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ তোলেন নুরুজ্জামান।
মোবাইল ফোনে অভিযোগের বিষয়ে ইউনুছ আলী বলেন, অনৈতিক সুবিধা না দেওয়ায় আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন সুবিধাভোগীরা। যারা এখন অভিযোগ করছেন, তারা শিক্ষক নিয়োগে আমার সইও জাল করেছেন।